ব্যবসার জন্য ঋণ নেওয়া অনেক গ্রাহক এখন ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ ফেরত দিচ্ছেন না। যদিও তাদের কাছে তা দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তারা নানা টালবাহানা এবং সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ব্যাংককে অর্থ ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। এই ধরনের গ্রাহককে বলা হয় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি।
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা ও মোট ঋণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী:
-
ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা: ৩,৪৮৩ জন
-
আটকে থাকা ঋণ: ২৮,৮৭৮ কোটি টাকা
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে। তবে সব ব্যাংক এখনও তাদের তালিকা পাঠায়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সমস্যা বেশি
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ইচ্ছাকৃত খেলাপি সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক এখনও তালিকা পাঠায়নি এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেও খেলাপি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
মোট ঋণখেলাপির চিত্র
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত:
-
ব্যাংক ঋণগ্রহীতার সংখ্যা: ৭৬ লাখ ৫,৯২৩ জন
-
খেলাপির সংখ্যা: ১৪ লাখ ৯,৫৪৮ জন (প্রায় ১৯%)
-
মোট ব্যাংক ঋণ: ২০ লাখ ৪৪,৩৯৬ কোটি টাকা
-
খেলাপি ঋণ: ৬,৬৭,১১৫ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৩৩%)
ইচ্ছাকৃত খেলাপি বৃদ্ধির কারণ
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংক খাতে অনিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সহজে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ ইচ্ছাকৃত খেলাপি বাড়াচ্ছে। অনেক বড় ব্যবসায়ী ঋণ নিয়ে তা পরিশোধে অনীহা দেখাচ্ছে। কেউ কেউ আদালতের আশ্রয় নিয়ে সময়ক্ষেপণ করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট তৈরি হচ্ছে এবং নতুন ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
ব্যাংকগুলোর উদ্যোগ
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের তালিকা ব্যাংকগুলোতে পাঠিয়েছে। তালিকাভুক্ত গ্রাহকদের নতুন ঋণ, গ্যারান্টি বা ট্রেড ক্রেডিট দেওয়া যাবে না। এই প্রক্রিয়া ২০২৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু ১৫টি ব্যাংকই এখন পর্যন্ত তালিকা পাঠিয়েছে।
উদাহরণ:
-
ইউনিয়ন ব্যাংক: ১১৯ জন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, আটকে থাকা ঋণ ৬,২৯৯ কোটি টাকা
-
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ১২৭ জন শনাক্ত, প্রাথমিকভাবে ১২,৫০০ কোটি টাকার ঋণ
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার কঠিন হবে। এজন্য:
-
ইচ্ছাকৃত এবং অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের আলাদা করা উচিত।
-
অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের ব্যবসা সচল রাখতে সহায়তা করা উচিত।
-
ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।
ড. শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, “বাংলাদেশে খেলাপি গ্রাহকদের আইনের আওতায় আনার কোনো উদাহরণ নেই। নেপালে খেলাপিদের নাম প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হয়। আমাদেরও তা বিবেচনা করা উচিত।”
উপসংহার
ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শুধু ব্যাংক নয়, সাধারণ আমানতকারী এবং দেশের অর্থনীতিকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী পুনঃতফসিল এবং রিকভারি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে, কিন্তু কঠোর আইনি পদক্ষেপ এবং সামাজিক জবাবদিহি ছাড়া সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
No comments: